নেশাখোরের ভিক্ষাবৃত্তি— সাখাওয়াত সজীব
যুব সমাজ একটি দেশও জাতির বহু আশা আখাংকার আধার। যে বয়সে তারা আত্মনিয়োগ করলে আল্লাহর ইচ্ছায় পারবে না হেন কাজ কমই আছে। যুবক বয়সে ইবাদত কবুল হওয়ার ঘোষনাও আল্লাহ গ্যারান্টি দিয়েই ঘোষনা করেছেন। ব্যক্তি পরিবার সমাজ এর মত গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট সমূহ যুবকেরা যে ভাবে গড়বে ঠিক সে ভাবেই গঠিত হবে। তবে সর্তক থাকতে হবে, বয়সের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে এ সময় তারা হতে পারে ভুল পথে পরিচালিত কিংবা কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে তাদের নিজের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন।
এ যুব সমাজ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা উচ্চ শিক্ষিতও হতে পারে, অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত যুবকেরা বড় ধরনের তেমন কোন চাকুরীর জন্য অপেক্ষা না করে যে কোন কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে ফেলে। তবে এ ধরনের যুবকদের মধ্যে আবার দেশের বাইরে গতর খাটাতেই বেশ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। কেউ বাবার ভিটা-মাটি, মায়ের অলংকারাদি, দুধের গাভী বিক্রি করে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমাতে দেখা যায়। আবার কেউ কেউ কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার গলায় পা দিয়ে ভিসার টাকা যোগাড় করে। সবই অনাগত একটি সুন্দর জীবনের লক্ষে। দূভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, সবার সাধপূরণ হয় না। কেউ কোন মতে চলতে পারেন, দু’চারখানা ইট গেড়ে চরম প্রশান্তি পান। বিপরীতে ভিসা জালিয়াতির খাপ্পরে পড়ে, বিদেশে জেল জরিমানা, অনাহার ও অর্ধাহারে শেষ পর্যন্ত মাথা কামিয়ে দেশের মাটিতে চরম হতাশা নিয়ে ফিরে আসেন। আবার নতুন চুল না গজাঁনো পর্যন্ত অনেকেই ঢাকাতেই পড়ে থাকেন।
বাবার টাকায় দীর্ঘ সময় ক্ষেপন করে দু’চারখানা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করার পর শিক্ষিত যুবকেরা চাকুরীর জন্য হন্যি হয়ে ঘুরতে থাকে। এ অফিস, সে অফিস, এত লক্ষ, অত লক্ষ, এ নেতা ও নেতা, এ দল ও দল- কোনটাই বাদ রাখে না। অবশেষে কালে ভদ্রে দু’চার জনের চাকুরী হলেও বাকীদের সরকারী চাকুরীর বয়সত শেষ হয়েঈ যায় বরং বেসরকারী গুরুত্ব টুকু পর্যন্ত থাকে না। এ দিকে শেষ হয়ে যাচ্ছে বিয়ের বয়স, চলে যাচ্ছে তার পছন্দের প্রিয়সী অন্যের ঘরে।
দেশ-জাতীয় এ বেষ্ট পার্ট (অন্যতম অংশ) বাবা-মা, ছোট ভাই বোন স্ত্রি-পুত্রের ভরন পোষনের দায়-দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়ে চলে যায় এক অন্ধকার জগতে। দূরত্ব বাড়তে থাকে তার আপনজনদের কাছ থেকে। বেকারত্ব আর নিরাশার খপ্পরে পতিত এই সোনার ছেলেগুলোকে নিজেদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করতে থাকে একটি প্রভাবশালী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র। তাদের সুন্দর বিবেক বুদ্ধিকে ধ্বংশ করতে না পারলে তারা এক সময় ঐ অসৎ চক্রের সাথে বাদ প্রতিবাদে জড়িত হয়ে পড়তে পারে। তার জন্য ঐ অসৎ চক্র এই হতাশাগ্রস্থ যুবশক্তিকে নেশার জগতে নিয়ে যায়। শতভাগ বিবেক ধ্বংশের পর খুন, চিনতাই, ডাকাতীর মত জগন্য দূষ্কর্ম সমূহ তাদের দিয়ে ঘটিয়ে থাকে।
উল্লেখিত কাজটিরও কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটে। সব সদস্য সমান তালে হয়ত: চিহ্নিত বস্দের অনুগত হয় না। প্রাণে বাঁচার জন্য অন্যত্র কেটে পড়ে। কিন্তু তখনও তার নেশার ঘোর কাটে না। যে কোন ভাবে ভাতের নয়, নেশার টাকা জোগাড়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে।
চাঁদপুর কোর্ট ষ্টেশন, সন্ধ্যের সোনালী আভা তখনও পুরোপুরি কাটেনি। আমি এক প্রকার একাই প্লাটফর্মে পায়চারী করছি। করতে করতে এক সময় পূব মাথায় একাকি চলে আসলাম। একজন লম্বাটে ২৫/২৬ এর যুবক, যাকে দেখলেই মায়া লাগে, তবে লাল চক্ষুর কৌতুহলী দৃষ্টিতে ভয় যে লাগে না তাও নয়। সে আমাকে বিনয়ের সাথে সালাম দিয়েই হাউ-মাউ করে পা জড়িয়ে অঝোর ধারায় কান্না জুড়ে দিল। তাকে শান্ত করে কারণ জানতে চাইলে ধীর অথচ অনড় কন্ঠে জানাল, সে মায়ের একমাত্র সন্তান, আজ মা ক্যান্সার হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। বিধবা মায়ের চিকিৎসায় ভিটে মাটি কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। শেষ পর্যন্ত ৪০০ টাকা এক একটি ইনজেকশানের জন্য কুলির কাজ, রিক্সা কোনটাই বাদ রাখে নি। আজ বৃষ্টির কারণে কারো কাছে যেতে না পারায় মায়ের আত্ম চিৎকারে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠতেছে। বলতে বলতে আবার হাউ-মাউ কান্না।
‘মা’-জগত জননী। তাও আবার বিধবা, একমাত্র সন্তান, কথা গুলো আমার কবি হৃদয়ে ভীষণ ভাবে আঘাত হানলো। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। পকেটে যে কটা মাঝারি নোট ছিল, সবকটিঈ তাকে দিয়ে দিলাম। মা শান্তি পাক, হয়ত: আমার স্নেহময়ী জননীও কবরে একটু শান্তি পেতেও পারেন। তার কান্না থামলো, প্রশান্তির হাসি ফুঁটলো চিকন দু’টি ঠোঁটের কোনে, দু’হাত তোলে সে কী দোয়া! সে চলে গেল তার আপন গন্তব্যে- আমি গাড়ির জন্য আবার অপেক্ষা করতে থাকলাম।
একজন বাদাম বিক্রেতা। বয়স ৪০/৪২ এর কম নয়। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “স্যার এ যে টাকা গুলো দিলেন, জানেন- ও কী করবে? ও বড় লোকের সন্তান, বাড়ি চট্টগ্রামে মা-টা কিচ্ছুনা ও নেশা কিনবে, নেশা।”
কার্টেসি: গাজী কবির মেহারী