শ্রাবন্তী—সাখাওয়াত সজীব

মাঠের মাঝে বলতে গেলে সেটি ছাড়া আর কোন বাড়ি নজরে পড়ে না। বর্ষায় মাঠ ভরে গেলেও পানি তেমন বরকত ধরে না। আর ধরবেই বা কি করে; অন্যান্য এলাকার তুলনায় শ্রাবন্তীদের এই বাড়িটি বেশ উঁচু। আসপাশে বছরে তিন ফসল ফলায়ে গ্রামবাসী বেশ উৎপুল্ল। একদম অজপাড়াগাঁও বলা যেত না। যদি না বাড়িটিতে বিদ্যুৎ ও পথঘাট থাকত। 
এমন একটি নীরব বাড়িতে মা-বাবাসহ শ্রাবন্তী একাই থাকে। পাশে একটি টিনসেড দালান থাকলেও তা বন্ধ থাকে বছরে পৌনে বারো মাস। সামনের ছোট্ট পুকুরটি স্বচ্ছ পানিতে টইটুম্বর থাকে হর হামেশা। গোটা দু’য়েক বাঁকা তালগাছ যেন সে কত কালের স্বাক্ষী। টাপুর টুপুর তাল ঝরার শব্দে শ্রাবন্তীদের মজার ঘুমে তেমন একটা ব্যাঘাত ঘটে বলে মনে হয় না। 
ঘরের সামনে বিশাল সজনে গাছটি যেন তাদের পুরো ঘরখানিকে আগলে রেখেছে আপন মমতায়। সজনে পাতার ভর্তা! সে এক অপূর্ব স্বাদ। অতিপাকা নারকেল তৈলহীন শুকনো ছোট মাছের বাটনা। যদি শ্রাবন্তীর মায়ের হাতে না খেতাম, তাহলে বোধ হয় আজো জীবে পানি আসত না। বাড়িটি ছোট্ট হলে কি হবে; কী ফল ফলারী নেই সেখানে; কমলা, আংগুর, আপেল-সে ত এদেশের অনেক অভিজাত বাড়িতেও নেই। 
বাবা-অতিশয় সরল সহজ একজন গ্রাম্য বয়স্ক ভদ্রলোক। তেমন একটা লেখাপড়া না শিখলেও ছোট ভাইদের শিক্ষিত করে তুলেছেন অতি যতেœ। অবশ্য তাঁরা আজ আর এ বাড়িতে থাকেন না। গোটা কয়েক গাভী গরু, ফসলী ক’টুকরো জমি আর নামাজ কালামে কেটে যায় তাঁর দিনগুলো। বড় মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন সে অনেক আগেই। বড় ছেলের বউ বেশিদিন এ বাড়িতে ‘এডজাষ্ট’ করেনি। তাঁরাও আজ শহরমূখী। 
মা-তিনিও তার পিতার বড় সন্তানই নন বরং একমাত্র কন্যাও বটেন। বয়স স্বামীর চেয়ে মাত্র বছর পাঁচেক কম। নানা রকম রোগশোকে ভূগছেন শ্রাবন্তীর মা। ডাক্তার ও ঔষদ যেন নিত্য সাথী তাঁর। মাঝে মধ্যে শুয়েছেন ত উঠতে পারবেন বলে মনে হয় না। মেয়েদেরও যার যার সংসার হয়েছে। ইচ্ছে করলেই দু’দিন বেড়ানোর সুযোগ নেই তাদের। 
এত রোগশোকের মাঝেও ভোরে ভোরে শ্রাবন্তীকে গরম ভাত ক্যারিয়ারের ভরে দিতে হয়। না হলে দুপুরে যে তার ছোট্ট সন্তান অফিসে কষ্ট পাবে। তাছাড়া কম্পিউটার অপারেটর-এ যেন এক ফাঁকি-ঝুঁকিহীন চাকুরি। চাকুরির ফাঁকে তাকে কলেজও করতে হয় মাঝে সাজে। সামান্য বেতনে চলে না বলে নিজেই সকাল-বিকালে সময় দেয় নিজের একটি প্রযুক্তি ব্যবসার দোকানে। 
ইচ্ছার বাইরেই ঘুম থেকে উঠতে হয় তাকে। তারপর যেন এক অসহায় পথচলা। বহুদূর গেঁয়োপথে হেঁটে এসে উঠতে হয় অটো নামক একটি ছোট্ট যানে। তারপর আবার সিএনজি। অত:পর অফিস। ফের বিকেলে ব্যবসায়। ক্লান্তদেহে নিত্য দিনের মত রাতে যখন বাড়ি ফেরে, সমস্তÍ পথে তার হৃদয়পটে বাকী দশটা তরুনীর মত নূতন স্বপ্নের জাল তছনছ করে শুধু ভেসে উঠে- বৃদ্ধ মা-বাবার দু’টি মায়াবী মুখ, চার-চারটি অন্তহীন দৃষ্টি। 
একজন লেখক হওয়ার কারণেই মূলত শ্রাবন্তীর সাথে আমার পরিচয়। ‘ও’ কম্পিউটারে এতটাই পরিপক্ক যে, আমার কম্পোজসহ অন্যান্য কাজে মোটেই বেগ পেতে হয় না। কাজের ফাঁকে আমি লেখকসুলভ স্বভাবে ‘ও’কে জানতে চাইতাম আর সে তারুণ্যের দোষে দুষ্ট হয়ে আমাকে আড়াল করতে চাইত। ধীরে ধীরে ব্যবধান কমতে লাগল। আমার সাথে গড়ে উঠল তার সখ্যতা। হলে কি হবে; অতি মাত্রায় লাজুক হওয়ায় আজো তার অনেক কিছুই রয়ে গেছে আমার অজানা। তাছাড়া বয়সের ব্যবধানটাকেও এক্ষেত্রে একদম ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। 
ওর এত কাজের ফাঁকে কখনও ‘ও’কে আনমনা দেখাত। একদিন ডেক্সটপে হাসীর নাটক দেখছে, অথচ মন খারাপ, সহাস্যে বললাম, “কিরে কেউ কি দেখতে এসেছে?” মুহুর্তেই নিজকে স্বাভাবিক অবস্থায় এনে, হৃদয়ের সবটুকুন দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে দিয়ে বলল, “স্যার আমার মা-বাবার কি হবে?” 
কার্টেসি: গাজী কবির মেহারী
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )